মহিমান্বিত শবে বরাত | করণীয় ও বর্জনীয়
শবে বরাত অত্যন্ত বরকতময়, মহিমান্বিত ও ফযীলতপূর্ণ রাত। ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে অদ্যাবধি এ রাত মুসলিম উম্মাহর নিকট বৈশিষ্ট্যময় রাত হিসেবে স্বীকৃত। সহীহ হাদীসের বর্ণনানুযায়ী এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাহর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন, তাদের প্রতি রহমত নাযিল করেন, আপন দয়ায় তাদের দু‘আ কবূল করেন এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন।
ইমাম আবদুর রাযযাক আস সান‘আনী (র.) তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে ইবনে ওমর (রা.)-এর একটি বর্ণনা স্বীয় সনদে উল্লেখ করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন- পাঁচ রাতে দু‘আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না (অর্থাৎ দু‘আ কবূল হয়ে থাকে)। এ পাঁচ রাত হলো- জুম‘আর রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত ও দুই ঈদের রাত। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, খ- ০৪, পৃষ্ঠা ৩১৭)
ক্ষমা ও দুআ কবূলের রজনী হিসেবে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমল, হাদীস শরীফের নির্দেশনা এবং সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে তাবিঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও সলফে সালিহীনের অনুসরণে এ রাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করতে পারি। যেমন :
(ক) রাতে জাগ্রত থাকা :
ইবাদত বন্দেগির উদ্দেশ্যে শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। আরব-অনারবে স্বীকৃত হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফতওয়ার কিতাব ‘ফতওয়ায়ে শামী’তে শবে বরাতে জাগ্রত থাকাকে মানদুব তথা মুস্তাহাব বলা হয়েছে।
শবে বরাতে জাগ্রত থাকার অর্থ হলো, রাতের অধিক সময় আনুগত্যমূলক কাজে ব্যস্ত থাকা। কেউ কেউ বলেন, রাতের কিছু অংশ কুরআন তিলাওয়াত করবে অথবা তিলাওয়াত শুনবে, অথবা হাদীস পাঠ করবে কিংবা পাঠ শুনবে, তাসবীহ-তাহলীল করবে অথবা দরুদ শরীফ পড়বে। (মারাকিল ফালাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা ১৭৪)
(খ) কবর যিয়ারত করা ও মৃত আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমানদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা :
শবে বরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশেষ আমলের মধ্যে রয়েছে যে, তিনি এ রাতে জান্নাতুল বাকী কবরস্থান যিয়ারত করেছেন এবং মৃত মুমিনদের জন্য দুআ-ইস্তিগফার করেছেন। সুতরাং এ রাতে কবরস্থান যিয়ারত করা, মৃত আত্মীয় স্বজন, পিতা-মাতা ও মুসলমানদের জন্য দু‘আ করা, এবং তাদের মাগফিরাত কামনা করা উত্তম কাজ।
(গ) আল্লাহর দরবারে দু‘আ করা :
হাদীস শরীফে আছে, এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। অন্য বর্ণনায় আছে, এ রাতে আল্লাহ পাক এই বলে আহবান করেন: “তোমাদের মধ্যে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো প্রার্থনাকারী কি আছে? আমি তার চাহিদা পূর্ণ করে দেব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যেই চাইবে তাকে দান করা হবে, কেবল ব্যভিচারী ও মুশরিক ব্যতীত।” সুতরাং এ রাতে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে নিজের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করা উচিত।
(ঘ) নফল নামায আদায় করা :
এ রাতের করণীয় আমলের অন্যতম হলো বেশি বেশি করে নফল নামায আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ সিজদা সহকারে এ রাতের দীর্ঘ সময় নামাযে অতিবাহিত করেছেন। সলফে সালিহীনগণ নামাযের জন্য এ রাতকে খাস করে নিতেন। তবে শবে বরাতের নামাযের জন্য নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই। নিজের মনের চাহিদা অনুযায়ী যত রাকা‘আত ইচ্ছা পড়তে পারেন, যে কোনো সূরা দিয়ে পড়তে পারেন। এ বিষয়ে কোনো শর্ত নেই। দীর্ঘ নামায পড়তে চাইলে এ রাতে সালাতুত তাসবীহ পড়া যেতে পারে।
সালাতুত তাসবীহ-এর নিয়ম হলো: চার রাকাআত সুন্নত নামাযের নিয়ত করবেন। তাকবীরে তাহরীমার পর ছানা (সুবহানাকা আল্লাহুম্মা…) পাঠ করবেন। তারপর এই তাসবীহ- “সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার” ১৫ বার পাঠ করবেন। তারপর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহসহ সূরা ফাতিহা পাঠ করবেন। তারপর এর সাথে অন্য যে কোনো সূরা মিলিয়ে পড়বেন। এরপর রূকূতে যাওয়ার আগে ১০ বার উপরের তাসবীহ পাঠ করবেন। তারপর রূকূতে গিয়ে রূকূর তাসবীহ (সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম) পড়ার পর ১০ বার ঐ তাসবীহ পাঠ করবেন। রূকূ থেকে দাঁড়িয়ে ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ পড়ার পর ১০ বার ঐ তাসবীহ পাঠ করবেন। তারপর সিজদায় গিয়ে সিজদাহ’র তাসবীহ (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা) পড়ার পর ঐ তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন। তারপর দুই সিজদার মাঝখানের বৈঠকের তাসবীহ পাঠ করে ঐ তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন। তারপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে সিজদাহ’র তাসবীহ পাঠ করে ঐ তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবেন। এভাবে চার রাকাআত নামায পড়বেন। এতে প্রতি রাকআতে ৭৫ বার করে চার রাকাআতে মোট ৩০০ বার উপরোক্ত তাসবীহ পাঠ করতে হয়। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ- ১, পৃষ্ঠা-২২৩)
লা-মাযহাবী সালাফীদের মান্যবর শায়খ ইবনে তায়মিয়া শা’বানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাতে নামায আদায় করাকে উত্তম বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হলো- যদি কোনো ব্যক্তি শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে একাকী অথবা বিশেষ জামা‘আতে নামায আদায় করে, যেমন একদল সলফে সালিহীন করতেন, তাহলে এটা উত্তম। (আল ফাতাওয়া আল কুবরা, খ- ২, পৃষ্ঠা ২৬২)
(ঙ) কুরআন তিলাওয়াত ও শরী‘আত সম্মত অন্যান্য ইবাদত বন্দেগি করা :
উপরোক্ত আমলসমূহ ছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত, যিক্্র-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, দান-খয়রাতসহ শরী‘আতসম্মত অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে এ রাত অতিবাহিত করা সওয়াবের কাজ। কেননা এসব আমল সব সময়েই উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত।
(চ) ১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা :
১৫ শা’বান দিনে রোযা রাখা একটি তাৎপর্যপূর্ণ আমল। এ দিনের রোযা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত: এটি শা’বান মাসের অন্তর্ভূক্ত একটি দিন, যে মাসে রাসূল (সা.) অধিক রোযা রাখতেন। দ্বিতীয়ত: এটি আইয়ামে বীযের অন্তর্ভূক্ত। আইয়ামে বীয হলো প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তম দিন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ তিন দিন রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারী)। তৃতীয়ত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১৫ শা’বানে বিশেষভাবে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিনে সিয়াম পালন করবে। (ইবনে মাজাহ, খ- ১, পৃষ্ঠা- ৪৪৪)
শবে বরাতের করণীয় সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী ‘লাতায়িফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে লিখেছেন- মুমিনগণের জন্য উচিত হলো এ রাতে আল্লাহর যিকরে একান্তভাবে মনোনিবেশ করা এবং নিজের গুনাহ মাফ, দোষ-ত্রুটি গোপন করা ও বিপদাপদ দূর করার জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আর মধ্যে নিবিষ্ট থাকা আর গুনাহের জন্য তাওবা করা। কেননা এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা তাওবা কবূল করেন।
কেউ কেউ বলে থাকেন এ রাতের ফযীলত বিষয়ে কোনো সহীহ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস নেই। এ বক্তব্য সঠিক নয়। শায়খ ইবনে তায়মিয়া বলেন- “শা’বানের মধ্যবর্তী রাতের ফযীলত সম্পর্কে অনেক মারফূ হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে এটি একটি মর্যাদাবান রাত।” (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম, পৃষ্ঠা ২৫৭)
একইভাবে নাসির উদ্দীন আলবানী, যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বক্তব্যকে বর্তমান লা-মাযহাবী সালাফীরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তিনি শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং শবে বরাতের ফযীলতকে স্বীকার করেছেন। তিনি হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণিত হাদীস : “আল্লাহ তাআলা শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন” সম্পর্কে বলেছেন- হাদীসটি সহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে, যা একে অন্যকে শক্তিশালী করে। এ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কিরাম হলেন- ১. হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) ২. আবূ সা’লাবা আল খুশায়নী (রা.) ৩. আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ৪. আবূ মূসা আল আশআরী (রা.) ৫. আবূ হুরায়রাহ (রা.) ৬. আবূ বকর (রা.) ৭. আউফ ইবনে মালিক (রা.) ৮. হযরত আয়িশাহ (রা.)। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা, খ- ৩, পৃষ্ঠা ১৩৫)
সুতরাং শবে বরাত সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস নেই এ রকম কথা বলা নিঃসন্দেহে মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানীও এরূপ বলেছেন। তার বক্তব্য হলো- “শায়খ কাসিমী (র.) ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থে আহলুত তা’দীল ওয়াল জারহ থেকে বর্ণনা করেন যে, শা’বানের মধ্যবর্তী রাতের ফযীলত বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। সুতরাং এর উপর নির্ভর করা উচিত নয়। যদি কেউ এরূপ কথা বলে তাহলে তা অস্থির মানসিকতার কারণে অথবা হাদীসের বিভিন্ন সনদ, যা আপনাদের সামনেই রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে পর্যালোচনা করার গভীরতা না থাকার কারণেই এরূপ বলে থাকে।” (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহা, খ- ৩, পৃষ্ঠা ১৩৫)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, শবে বরাত অত্যন্ত বরকতময় ও ফযীলতপূর্ণ। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, এ রাতে আল্লাহ তা’আলা মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত তাঁর সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। একজন মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে? আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত এ ক্ষমা তথা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় এবং তাঁর আরো অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় এ রাত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো উচিত।
মনে রাখা উচিত যে, শা’বান মাস ও মহিমান্বিত শবে বরাত মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের এক অনন্য সুযোগ। সুতরাং এ সময়ে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা আল্লাহর রহমত লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শবে বরাত নিয়ে সমাজে কিছু বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে : ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ ও রাস্তা-ঘাটে আলোকসজ্জা করা, বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা, আতশবাজি করা, পটকা ফোটানো, মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো ইত্যাদি। এ সকল বিদআত ও কুসংস্কার থেকেও আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন।
আল্লাহ আমাদেরকে নেক আমলের মাধ্যমে শবে বরাত অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
[মাওলানা নজমুল হুদা খান রচিত “শবে বরাত” শীর্ষক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত]